Customize Consent Preferences

We use cookies to help you navigate efficiently and perform certain functions. You will find detailed information about all cookies under each consent category below.

The cookies that are categorized as "Necessary" are stored on your browser as they are essential for enabling the basic functionalities of the site. ... 

Always Active

Necessary cookies are required to enable the basic features of this site, such as providing secure log-in or adjusting your consent preferences. These cookies do not store any personally identifiable data.

No cookies to display.

Functional cookies help perform certain functionalities like sharing the content of the website on social media platforms, collecting feedback, and other third-party features.

No cookies to display.

Analytical cookies are used to understand how visitors interact with the website. These cookies help provide information on metrics such as the number of visitors, bounce rate, traffic source, etc.

No cookies to display.

Performance cookies are used to understand and analyze the key performance indexes of the website which helps in delivering a better user experience for the visitors.

No cookies to display.

Advertisement cookies are used to provide visitors with customized advertisements based on the pages you visited previously and to analyze the effectiveness of the ad campaigns.

No cookies to display.

Take a fresh look at your lifestyle.

জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল এবং শিষ্টাচার ও নৈতিকতা

1,327

জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল এবং শিষ্টাচার ও নৈতিকতা। একটি স্থিতিশীল, সামাজিক এবং আদর্শমূলক সমাজ গড়তে সাহায্য করতে পারে। এর মাধ্যমে একটি সমাজ গঠন হতে পারে যেখানে জাতীয় শুদ্ধাচার, শিষ্টাচার এবং নৈতিকতা একত্রে প্রবৃদ্ধি করে। একজন নৈতিক ব্যক্তি তার আচরণে সাহায্য এবং সহানুভূতির মাধ্যমে সামাজিক নৈতিকতা ও মর্যাদার স্বচ্ছতা প্রদর্শন করতে পারে।

অংশ: জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল

শুদ্ধাচার বলতে সাধারণভাবে নৈতিকতা ও সততা দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষ বোঝায়। এর দ্বারা একটি সমাজের কালোত্তীর্ণ মানদ-, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্যও বোঝানো হয়। ব্যক্তি পর্যায়ে এর অর্থ হলো কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা, তথা চরিত্রনিষ্ঠা। এখানে শুদ্ধাচারের এই অর্থটিকেই গ্রহন করা হয়েছে। ব্যক্তির সমষ্ঠিতেই প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয় এবং তাদের সম্মিলিত লক্ষ্যই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রতিফলিত হয়।

প্রাতিষ্ঠানিক শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তি পর্যায়ে শুদ্ধাচার অনুশীলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; সমন্বিত রুপ হিসাবে প্রাতিষ্ঠানিক শুদ্ধাচার অনুশীলনও জরুরি। রাষ্ঠ্রীয় আইনকানুণ ও অন্যান্য নিয়মনীতি ও দর্শন এমনভাবে প্রণীত ও অনুসৃত হওয়া প্রয়োজন যাতে এগুলি শুদ্ধাচারী জীবন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়।

বাংলাদেশের সমাজ বিভিন্ন খাত, যথা রাষ্ঠ্র, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান এবং সুশীল সমাজে বিভিন্ন আইন কানুন, নিয়মনীতি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি পালন ও লালন করে শুদ্ধাচার অনুশীলন করে চলেছে এবং সময়ের চাহিদা অনুযায়ী তাতে সংস্কার ও উন্নয়ন সাধন করেছে।

 

বাংলাদেশের রুপকল্প ২০২১ এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, আগামী এক দশকে দেশটিতে ক্ষুধা, বেকারত্ব, অশিক্ষা, বঞ্চনা ও দারিদ্র দূর হয়ে দেশে বিরাজ করবে সুখ, শান্তি, সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধি। সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুযায়ী গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ’ এমন এক শোষনমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা হবে, ’যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে।

এই লক্ষ্য পূরণে সুশাসন প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য এবং সেই সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি দমন ও শুদ্ধাচার প্রতিপালন একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য পরাকৌশল। কিন্তু কেবল আইন প্রয়োগ ও শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব নয়, তার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে একটি আন্দোলন গড়ে তোলা, যাতে নাগরিকগণ চরিত্রনিষ্ঠ হয়, রাষ্ঠ্রীয় ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ও সুশীল সমাজের প্রতিষ্ঠাসমূহে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা পায়।

 

বাংলাদেশ জাতিসংঘের United Nation Convention Against Corruption (UNCAC) এর অনুসমর্থনকারী দেশ। দুর্নীতি নির্মূলের জন্য ’ফৌজদারী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন ও আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে দূর্নীতির প্রতিকার ছাড়াও দুর্নীতির ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এই কনভেনশনে।

 

শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে, তেমনই পরিবার, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও এনজিইও এবং শিল্প ও বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, সাকুল্যে অরাষ্ট্রীয় হিসেবে চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ভুমিকাও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ তিনটি অঙ্গে বিভক্ত – বিচার বিভাগ, আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগ। তারা স্বাধীন সত্তায় তাদের নিজস্ব কর্মবৃত্তে যথাক্রমে বিচারকার্য, রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন ও নির্বাহীকার্য পরিচালনা করে।  সংবিধান অনুযায়ী  গঠিত আরও কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেমন নির্বাচন কমিশন, মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশন, ন্যায়পাল, যারা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গঠিত এবং যারা বাজেট ও আর্থিক নিয়মাবলি অনুসরণ সাপেক্ষে নির্বাহী  বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে তাদের কর্মসম্পাদন করে।

অন্য আরও কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা আলাদা আইনের মাধ্যমে সৃষ্ট এবং সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ হিসেবে অভিহিত; যেমন, দুর্নীতি দমন কমিশন, তথ্য কমিশন, মানবাধিকার কমিশন ইত্যাদি। সংবিধানে স্থানীয় শাসনের যে ব্যবস্থা নির্দেশ করা হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রাম ও শহরের স্থাণীয় শাসন প্রতিষ্ঠান যেমন, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেরা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন গঠন করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠানের সকলের ভ’মিকাকেই গুরুত্ব প্রদান জরুরি।

 

রাষ্ট্র ও সমাজে দুর্নীতি দমন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আইনকানুন ও বিধিবিধানের সুষ্ঠু প্রয়োগ, তাদের পদ্ধতিগত সংস্কার ও উন্নয়ন, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত এবং তাদের সঙ্গে সংম্লিষ্ট সকলের চরিত্রনিষ্ঠা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গৃহীতব্য কার্যক্রম চিহ্নিত করা হয়েছে। যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বাছাই  করা হয়েছে তারা হলো:

ক. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান: ১. নির্বাহী বিভাগ, ২.জাতীয় সংসদ, ৩.বিচার বিভাগ, ৪.নির্বাচন কমিশন, ৫. অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, ৬. সরকারি কর্ম-কমিশন, ৭.মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, ৮. ন্যায়পাল, ৯. দুর্নীতি দমন কমিশন, ১০. স্থানীয় সরকার

খ. অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান: ১. রাজনৈতিক দল, ২. বেসরকারি খাতের শিল্প ও বানিজ্যিক প্রতিষ্টান, ৩. এনজিও ও সুশিল সমাজ, ৪. পরিবার, ৫. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ৬. গণমাধ্যম।

 

এই কৌশলটির রুপকল্প হল ‘সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা’- রাষ্ট্র এবং সমাজ হিসেবে এটিই বাংলাদেশের গন্তব্য; আর সেই গন্তব্যে পৌছানোর জন্য রাষ্ট্রে ও সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সবচেয়ে জরুরী কাজ। ‘জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল’ সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কৌশল হিসেবে বিবেচিত।

 

উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানসমূহ দুর্নীতি দমন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অব্যাহতভাবে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে চলেছে। এগুলিতে পদ্ধতিগত সংস্কারও সাধন করা হচ্ছে। তবে বর্তমানে এসব কার্যক্রম ও সংস্কার- উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় সাধন ও এগুলির একটি সম্মিলিত রুপ প্রদানের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে।

এই কৌশলটিতে সে উদ্যোগই নেওয়া হয়েছে। চিহ্নিত সকল প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তাদের কৃত্য, কৃতি, বিবর্তন, বর্তমান অবস্থা ও তাদের চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়েছে এবং প্রত্যেকের জন্য আলাদা কর্মপরিকল্পনা বিধৃত হয়েছে।

কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নকাল হিসেবে স্বল্পমেয়াদ (এক বছরের মধ্যে), মধ্যমেয়াদ (তিন বছরের মধ্যে) এবং দীর্ঘমেয়াদ (পাঁচ বছরের মধ্যে) চিহ্নিতকরা হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান/প্রতিষ্ঠানগুচ্ছের ক্ষেত্রে নিম্মোক্ত ছকে কার্যক্রম (Intervention)  চিহ্নিত করা হয়েছেঃ

 

ক্রমিক – কার্যক্রম –          কর্মসম্পাদন সূচক          – সময়   – দায়িত্ব –              সহায়তাকারী

 

মূলতঃ জনপ্রশাসনের মাধ্যমেই কৌশলটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। শুদ্ধাচার কৌশলটি বাস্তবায়নের জন্য একটি জাতীয় শুদ্ধাচার উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদের কয়েকজন সদস্য, কয়েকজন আইনপ্রণেতা, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন প্রতিনিধি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সচিব, এনজিইও ও সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম এবং ব্যক্তিখাতের শিল্প বানিজ্যিক – প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন প্রতিনিধি উপদেষ্টা পরিষদের অন্তর্ভূক্ত।

সুশীল সমাজ, শিল্প ও বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গণমাধ্যমের সদস্যগণ পরিষদে সরকার কর্তৃক মনোনীত হবেন। এই উপদেষ্টা পরিষদ বছরে অন্ততপক্ষে দু’বার সভায় মিলিত হয়ে এবং শুদ্ধাচার বিকেন্দ্রীকৃতভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এতে চিহ্নিত দায়িত্বপালনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে এবং সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ তাতে সহয়তা প্রদান করছে। প্রতি মন্ত্রণালয়ে নৈতিকতা কমিটি ও শুদ্ধাচার ফোকাল পয়েন্ট’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

তারা সংম্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শুদ্ধাচার ও দুর্নীতি দমন কার্যক্রম বাস্তবায়ন এবং পরিবীক্ষন করছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার সচিবালয় হিসেবে কাজ করছে এবং সার্বিকভাবে সকল কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন করছে।

দুর্নীতি দমন ও শুদ্ধাচারকে স্বীকৃতি প্রদান ও উৎসাহিতকরণের জন্য শুদ্ধাচার পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে। সেই লক্ষ্যে নির্বাহী বিভাগ, ব্যবসায় খাত ও সুশীল সমাজে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে যারা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবেন তাদের জন্য সরকার বার্ষিক পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে।

 

এই কৌশলটির রূপকল্প হচ্ছে সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা। বাংলাদেশ ও তার সংগ্রামী মানুয়ের এটিই হল কাখিত গন্তব্য। সেই লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য রাষ্ট্র, তার প্রতিষ্ঠানসমূহে ও সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করবে তা-ই প্রত্যাশিত। শুদ্ধাচার কৌশলকে এ প্রত্যাশা পূরণের একটি অবলম্বন হিসেবে প্রণয়ন করা হয়েছে।

আশা করা যায় যে, এই কৌশলটির অনুসরণ ও বাস্তবায়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে জনগণ ও জাতির পিতার স্বপ্ন’সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠায় কার্যকর অবদান রাখবে। উল্লেখ্য যে, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরসহ তার আওতাধীন সকল প্রতিষ্ঠানে নির্দেশনা অনুযায়ী জাতীয় শুদ্ধাচার  কৌশল এর চর্চা পরিচালিত হচ্ছে।

 

অংশ: শিষ্টাচার নৈতিকতা 

মূলত ভদ্র ও মার্জিত আচরণই শিষ্টাচার। একজন ভদ্র ও শিক্ষিত ব্যক্তির আচার ব্যবহার, কথা বার্তা, চাল-চলন ও কাজকর্মে যে মিষ্টতা, নম্রতা ও মার্জিত রুচির প্রকাশ পায় তার সমষ্টিগত অবস্থাকে এক কথায় আদব-কায়দা বা শিষ্টাচার বলা হয়।

শিষ্টাচারের আর একটি দিক হচ্ছে আমি যে ধরণের আচরণ অন্যের কাছে প্রত্যাশা করি, আমারও উচিৎ সে ধরণের আচরণ অন্যের সাথে করা। আচরণে ভদ্রতা ও সুরুচিবোধের যৌক্তিক মিলনের নাম শিষ্টাচার। শিষ্টাচার মনের সৌন্দর্যের বাহ্য উপস্থাপনা।

মানুষের মার্জিততম প্রকাশ ঘটে সৌন্দর্যবোধের মাধ্যমে। যে মানুষ যত বেশি শিষ্ট তার প্রিয়তাও তত বেশি। আর এই শিষ্টতা তার চরিত্রকে করে আকর্ষণীয়। অর্ন্তগত মহত্ব মানুষকে উদার করে। আর সেই উদারতা ব্যক্তিকে রুঢ় করে না, তাকে শিষ্ট আর ভদ্র হতে শেখায়। মানুষের মাঝে এই মহত্বের পরিশীলিত প্রকাশই শিষ্টতা।

 

নৈতিকতা নীতি শব্দ হতে উদ্ভব হয়েছে। নীতি অর্থ কোন সার্বভৌম শক্তি কর্তৃক নির্ধারিত আইন বা নিয়ম কানুন। নেতিকতার সাধারণ অর্থ সততা বা ন্যায়পরায়নতা অর্থাৎ সততা, নিষ্ঠা ও শৃংখলাবোধ এর সমন্বিত গুণটির নাম হচ্ছে নৈতিকতা। এটি এমনই একটি বিষয় যা শুধু অনুধাবন করা সম্ভব। একে ধরা ছোয়াঁ যায় না বা পরিমাপ করা যায় না। প্রশাসক বা কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারির সততা, ন্যায়পরায়নতা, মানবিক মূল্যবোধ, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি তার কর্তব্যবোধ ইত্যাদি নৈতিকতার অন্তর্ভুক্ত।

একটি কল্যাণধর্মী রাষ্ট্রে প্রশাসন যন্ত্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রুচিসম্মত আচরণকে আমরা প্রশাসনিক শিষ্টাচার বলতে পারি। প্রশাসনে শিষ্টাচারকে Two way traffic  বলা যায়। অধঃস্তন কর্মকর্তা- কর্মচারীদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা, সম্মান ইত্যাদি পেতে হলে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকেও কিছু গুণাবলির অধিকারী হতে হবে। যেমন-বুদ্ধিমত্তা, উত্তমমানের স্মৃতিশক্তি, বাগ্নিতা, দৃঢ়তা, ন্যায়পরায়নতা, উচ্ছল ও প্রানবন্ত, ধৈর্য, বিনয় এবং হিংসা ও সংকীর্ণতা পরিহার ইত্যাদি।

প্রশাসনে শিষ্টাচার তথা নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার জন্য নিম্মবর্ণিত গুণাবলি থাকা আবশ্যক

ক.          সুষ্টিকর্তাকে ভয় করা;

খ.           প্রয়োজনে বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে পরামর্শ করা;

গ.           ন্যায়পরায়ন হওয়া

ঘ.           জ্ঞানীগুণীর সাহচর্য লাভ করা;

ঙ.           গঠনমূলক সমালোচনার প্রতি সহনশীল হওয়া

চ.            অস্থিরতা পরিহার করা।

 

প্রশাসনে নৈতিকতার প্রয়োজনীয়তা

প্রশাসন পরিচালনার জন্য আইন-কানুন, বিধি-বিধান থাকা সত্বেও নৈতিকতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আইনসম্মত বিধি-বিধান প্রশাসনিক নৈতিকতার সীমা নির্দেশ করে দেয়। যা প্রকৃত অর্থে প্রশাসনিক অঙ্গণে নৈতিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করে। তা ছাড়া আইন-কানুনের বাইরেও সচেতন কর্ম প্রচেষ্টা নৈতিক মূল্যবোধর জন্ম দেয়। যা প্রশাসনে খুব জরুরি। কারণ নৈতিকতার গুণে-

ক. অফিসের সুনাম বজায় থাকে;

খ. দায়িত্ব পালন যথাযথ হয়;

গ. আদেশ ও নিষেধের প্রতি যতœবান হওয়া যায়

ঘ. উর্ধ্বতনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং অধঃস্তনের প্রতি ক্ষমাশীল ও সহমর্মীতাবোধ জাগ্রত করে;

ঙ. অফিসের কাজের গোপনীয়তা বজায় রাখা যায়;

চ. রাষ্ঠ্র ও সরকার বিরোধী কাজ হতে বিরত থাকা যায়;

ছ. দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখ-তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া যায়;

জ. জনগণের ভালবাসা পাওয়া যায়;

ঝ. সর্বোপরি একজন সরকারী কর্মচারীর নৈতিকতা বজায় রাখার মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে পারেন।

 

অংশ: শিষ্টাচারের ব্যপ্তি বা ক্ষেত্র

ক. দাপ্তরিক শিষ্টাচার : একজন কর্মকর্তার সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে তার শিষ্টাচার ও নৈতিকতার উপর। এরা ব্যবস্থাপনায় দক্ষ হন। এদের অধিনস্থরা হয় খুবই আন্তরিক ও সুশৃংখল। তাই দাপ্তরিক কাজে শিষ্টাচার একটি অত্যাবশ্যকীয় গুণ।

খ. সামাজিক শিষ্টাচার : সমাজে ছোট-বড়, ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের লোকের বসবাস। পরস্পরের দেখাসাক্ষাতে কুশল বিনিময় ও যুক্তিপূর্ণ আচরণ, সমাজে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান ও ভালবাসার মাধ্যমে সামাজিক সম্পৃতি বৃদ্ধি পায় এবং নিজ নিজ অবস্থান সুদৃঢ় হয়।

গ. কথাবার্তায় শিষ্টাচার : একজন দক্ষ প্রশাসকের অপ্রয়োজনীয় কথা বর্জন করা খুবই জরুরি। উচ্চারণ পরিস্কার, বাচনভঙ্গি সুন্দর ও আকর্ষনীয় হতে হবে। উর্ধ্বতন কর্মকর্তা/কর্মচারীর কথায় ভুল ধরা বা অধস্তন কর্মচারীদের কথায় ত্রুটি আবিস্কার করা শিষ্টাচার বিরোধী।

ঘ. ভ্রমণকালীন শিষ্টাচার : ভ্রমণকালে কাউকে আসন থেকে তুলে দিয়ে নিজে আসন গ্রহন শিষ্টাচার পরিপন্থী। অবশ্য অধস্তন কর্মচারী/কর্মকর্তা উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সম্মানে আসন ছেড়ে দিলে সে আসনে বসতে দোষ নেই।

ঙ. টেলিফোন শিষ্টাচার : টেলিফোন করা এবং রিসিভ করার ক্ষেত্রেও শিষ্টাচার রয়েছে। এ উভয় ক্ষেত্রেই প্রথমে সালাম দিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলতে হয়। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে ফোন এলে বা তাঁর নিকট ফোন করলে তিনি যতক্ষণ লাইন বিচ্ছিন্ন না করেন ততক্ষণ ফোন না রাখাই শিষ্টাচারের অংশ।

চ. পত্র লিখনে শিষ্টাচার : উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট পত্র লেখার ক্ষেত্রে যথাযথ সম্মান ও বিনয় প্রকাশ করতে হয়। বক্তব্য সুস্পষ্ট ও স্ব-ব্যাখ্যাত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

ছ. অনুষ্ঠানাদিতে শিষ্টাচার : এগিয়ে গিয়ে সবার সঙ্গে নিজের পদবিসহ নাম বলে সৌজন্য বিনিময়, পরিচয় ও আলাপ করা চমৎকার ব্যক্তিত্তের লক্ষণ। স্ব স্ব পদমর্যাদা সম্পর্কে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে এবং সেভাবে উর্ধ্বতন, বয়স্ক ও অধঃস্তন কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করতে হবে। প্রধান অতিথি আসন গ্রহনের পর আসন গ্রহন এবং খাবার গ্রহনের পর খাবার গ্রহন করতে হবে। কোন দম্পতিকে পরিচয় করিয়ে দিতে হলে প্রথমে স্ত্রীকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে।

জ. পোশাক পরিচ্ছদে শিষ্টাচার :

অফিস আদালতে এবং অনুষ্ঠানাদিতে যোগদানকালে সকল কর্মচারীকে পোশাক সংক্রান্ত বিধিমালা অনুসরণ শিষ্টাচরের অঙ্গ। সুন্দর পোশাক পরিচ্ছদের পেশাগত ও বানিজ্যিক মূল্য ছাড়াও যথেষ্ট সামাজিক মূল্য রয়েছে। এটি একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বাড়িয়ে তোলে। পোশাক পরিচ্ছদের ব্যাপারে কয়েকটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, পোশাক পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও মার্জিত হতে হবে। সরকারি পোশাক দুই ধরনের:

১। আনুষ্ঠানিক সরকারি পোশাক

*              পায়জামা, আচকানসহ পাঞ্জাবী/শেরওয়ানী, মোজাসহ জুতা

*              টাইসহ স্যুট, মোজাসহ জুতা

*              মহিলাদের শাড়ী

২। নৈমিত্তিক সরকারি পোশাক

*              সাফারি স্যুট (অর্ধ/পুরা হাত) অথবা ট্রাউজার ও বুশ শার্ট (অর্ধ/পুরা হাত) অথবা ট্রাউজার ও ট্রাউজারের ভিতরে গুটানো শার্ট (অর্ধ/পুরা হাত) অথবা কমবিনেশন স্যুট অথবা শেরওয়ানীর সাথে পায়জামা বা ট্রাউজার।

*              কেবলমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ও ক্রীড়া সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে পোশাক বিধি শিথিলযোগ্য।

পোশাক সম্পর্কে যা বর্জনীয়:

*              চপ্পল, স্যান্ডেল বা মোজা ছাড়া জুতা পরা।

*              পায়জামা-পাঞ্জাবী পরা (আচকান পরা যেতে পারে)।

*              খেয়াল খুশি মত রং এর পোশাক পরা।

*              ফুল হাতা শার্টের আস্তিন গুটানো।

*              শার্টের উপরের দিকে বোতাম খোলা রাখা।

*              অপরিচ্ছন্ন, দুমরানো-মোচরানো পোশাক পরা।

ঝ. প্রশাসনিক শিষ্টাচার

*              অফিসে সময় মত উপস্থিত হওয়া

*              সভায়, প্রশিক্ষণে বা শ্রেণিকক্ষে, উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে সাক্ষাতের সময় মোবাইল ফোন সাইলেন্ট/বন্ধ রাখা

*              বস অফিস ত্যাগ না করা পর্যন্ত অফিসে থাকা এবং জরুরি প্রয়োজনে আবশ্যক হলে অনুমতিসাপেক্ষে অফিস ত্যাগ করা।

*              উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বক্তব্যের বিরোধিতা না করে বিনয়ের সঙ্গে বলা যায় ’আমিও আপনার সাথে একমত তবে আমার মনে হয় বিষয়টি………….।

*              বস বা উধ্বতন কর্মকর্তার দোষত্রুটি সম্পর্কে অন্যের সঙ্গে আলোচনা করা থেকে বিরত থাকা।

*              বস বা উর্ধ্বতনদের সঙ্গে অপ্রয়োজনে সাক্ষাৎ করা হতে বিরত থাকা। তবে সৌজন্য সাক্ষাৎ ভদ্রতা।

*              বস বা সিনিয়র কর্মকর্তা রুমে বা সভাস্থলে আগমনের সময় দাড়িঁয়ে সম্মান প্রদর্শন এবং বিদায়ের সময় এগিয়ে দেয়া।

*              কোন সভায় সভাপতির অনুমতি ছাড়া কথা না বলা, পাশের জনের সাথে কথা না বলা।

*              জেষ্ঠ্য ব্যক্তি বা মহিলাদের সম্মান জানানো এবং তাঁেদর দাঁিড়য়ে রেখে নিজে না বসা।

*              নিজের আচরণ ও পোশাক পরিচ্ছদ সম্পর্কে সচেতন থাকা।

*              সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের প্রবণতা এবং অন্যের কৃতিত্ব অবৈধভাবে গ্রহন করার প্রবনতা পরিহার করা।

*              না বলার কৌশল (আর্ট) জানা এবং আবশ্যক ক্ষেত্রে দৃঢ়তার সাথে অসম্মতি জ্ঞাপন করা।

*              নিজের যোগ্যতা জাহির করার জন্য অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করা থেকে বিরত থাকা।

*              অধঃস্তনদের উদ্যোগে বাধা না দিয়ে সঠিকভাবে তা পরিচালনা করা উচিৎ।

*              নিজের কাজের প্রচার না করে নীরবে কাজ করে যান।

*              উচ্চস্বরে কথা বলবেন না, তা শিষ্টাচার বিরুদ্ধ।

*              দোষ প্রমানিত না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী মনে করা থেকে বিরত থাকা।

*              অন্যের সামান্যতম সাহায্য ও সহযোগিতা সৌজন্য প্রদর্শনের জবাবে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা।

*              হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া থেকে বিরত থাকা। উত্তেজিত হলে মানুষ অসঙ্গতিপূর্ণ ও অশালীন কথাবার্তা বলে যা ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে।

শিষ্টাচার ও নৈতিকতা একটি আপেক্ষিক বিষয়। স্থান, কাল পাত্র ভেদে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে এর পরবর্তী বিকাশ নির্ভর করে। সৎ চরিত্রবান ব্যক্তি সমাজ ও জাতীয় জীবনে বিশেষ অবদান রাখতে পারে।

অশিক্ষা, কুশিক্ষা শিষ্টাচারের অন্তরায়, যা প্রতিনিয়ত মানবিক মূল্যবোধগুলো ধ্বংস করে সমাজকে করে তুলতে পারে নিঃস্ব রিক্ত সর্বশান্ত। এ থেকে পরিত্রান পেতে ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় জীবনে সুস্থতা ও সমৃদ্ধি অর্জনে আমাদের শিষ্টাচারের চর্চা করা উচিৎ।

শিক্ষকতা পেশার ধারণা ও এর প্রতি আবেগ অনুভূতি ও আগ্রহ সৃষ্টি

Comments are closed.