Take a fresh look at your lifestyle.

পাঠ্যবইয়ের পাতায় পাতায় ভুলের বেসাতি

110

এতদিন তথ্য বিকৃতিসহ বানান ভুল থাকলেও এ বছরের নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে জাতীয় সংগীতকেই ভুলভাবে উপস্থাপন করে ছাপানো হয়েছে। শুধু জাতীয় সংগীতই নয়, ভুল বর্ণনা দেয়া হয়েছে জাতীয় পতাকার ক্ষেত্রেও। ‘বঙ্গবন্ধু’কে বঙ্গবন্ধু এবং পুরো নাম না লেখে শুধু ‘শেখ মুজিব’ বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে।

সংবিধানে এক তথ্য থাকলেও পাঠ্যবইয়ে দেয়া হয়েছে মনগড়া তথ্য। দেশের কোনো সিটি করপোরেশনে ‘ডেপুটি মেয়র’ নামে পদ না থাকলেও পাঠ্যবইয়ে আছে বলে লিখে দেয়া হয়েছে। চলতি শিক্ষাবর্ষের ষষ্ঠ থেকে একাদশ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে এভাবেই ধরা পড়েছে ভুলের বহর। কোথায় নেই ভুল! আর এই ভুল দিয়েই শেষ হতে চলছে চলতি শিক্ষাবর্ষ।

৬টি শ্রেণির ১০টি পাঠ্যবইয়ে প্রায় পাঁচশোরও বেশি ভুল রয়েছে বলে জানা গেছে। ভুলে ভরা তথ্য সংবলিত এসব পাঠ্যবই পড়ে দেশের কোটি কোটি শিক্ষার্থীরা ভুল এবং বিকৃত ইতিহাস শিখছে। এ নিয়ে কারো কোনো গরজ নেই। এ যেন ভূতুড়ে কাণ্ড। পাঠ্যবই ঘেঁটে এসব ভুল পাওয়া গেছে। সোমবার (২০ সেপ্টেম্বর) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য। আমাদের পাঠকের জন্য তা এখানে তুলে ধরা হলো।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায় সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বইগুলো ছাপিয়ে বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়। আর একাদশ শ্রেণির বইয়ের পাণ্ডলিপি অনুমোদন দেয়ার পর প্রকাশকরা বই ছাপিয়ে বিক্রি করেন। কিন্তু প্রতি বছরই বইগুলোতে ভুল বের হয়। তারপর গণমাধ্যমে লেখা হলে এনসিটিবি একটি সংশোধন কমিটি গঠন করে জানায়, ভুল সংশোধন হচ্ছে। এই ভুল আর সংশোধন হয় না। পরের বছরও এই ভুল থেকে যায়। অর্থাৎ ভুলের এই বহর চক্রাকারে ঘুরতে থাকে।

দেশের শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় জানুয়ারিতে, শেষ হয় ডিসেম্বরে। করোনায় এ বছর প্রথম আট মাস ক্লাস বন্ধ থাকলেও বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিয়েছিল সরকার। বইয়ে যে পাঁচ শতাধিক ভুল রয়েছে তা নিয়েই শেষ হচ্ছে চলতি শিক্ষাবর্ষ। এই ভুল সম্পর্কে জানেই না পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। তবে এই ভুলের সংশোধন চেয়ে এরই মধ্যে হাইকোর্টে রিট করেছেন এক অভিভাবক। শিগগিরই এর শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।

জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি রবিবার বলেন, বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন থাকায় আমি এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না। তবে পাঠ্যবইয়ে কোথায় কোথায় ভুল হয়েছে তা আমি জেনে নেব।

পাঠ্যবইয়ের ভুল নিয়ে আদালতে যে রিট হয়েছে তা জানেন না জানিয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, বিষয়টি আমাদের কাছে এলে আমরা তা দেখব। ভুল সংশোধনেরও চেষ্টা করব। পাঠ্যবইয়ে প্রতিবারই ভুল থাকে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিবারই আমরা ভুল-ত্রুটি সংশোধনের চেষ্টা করি।

তবে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যানের কথা মানতে নারাজ অভিভাবকরা। এমন অসংখ্য ভুল সংশোধন করতে অনেক অভিভাবক এনসিটিবিকে চিঠি দিলেও কর্ণপাত করেনি তারা। শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টের দারস্থ হয়েছেন এক অভিভাবক। রিটকারীর আইনজীবী আলী মোস্তফা খান বলেন, তারা চান দ্রুত এই রিটের শুনানি হোক। কারণ নতুন শিক্ষাবর্ষে এসব ভুল সংশোধন না হলে আবারও শিক্ষার্থীদের হাতে ভুল বই যাবে।

পাঠ্যবই ঘেঁটে দেখা গেছে, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত ঢাকার বাংলাবাজারের এস এস পাবলিকেশন্স থেকে একাদশ শ্রেণির পৌরনীতি ও সুশাসন দ্বিতীয় পত্রের সপ্তম অধ্যায়ে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান শিরোনামে দুর্নীতি দমন কমিশনকে ‘সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে লেখা হয়েছে। অথচ এই তথ্য বাংলাদেশ সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত নবম-দশম শ্রেণির বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা বইয়ের একাদশ অধ্যায়ের পৃষ্ঠা নং-১৫০ নিম্ম থেকে ১০ নম্বর লাইনে ‘মাইল’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এক্ষেত্রে ‘মাইল’ শব্দটি প্রযোজ্য নয়। কারণ বর্তমানে দূরত্বের একক হিসাবে ‘কিলোমিটার’ ব্যবহার করা হয়। এই অধ্যায়ের ১৫৬নং পৃষ্ঠার নি¤œ থেকে ১৬নং লাইনে লেখা হয়েছে, ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে ও প্রাদেশিক নির্বাচনে দলটি (আওয়ামী লীগ) ‘একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে’। কিন্তু এখানে ‘নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে’ শব্দগুলো লেখা বাঞ্ছনীয়। পরের পৃষ্ঠার উপরে ২নং লাইনে যুক্তফ্রন্ট মূলত চারটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এখানে চারটির স্থলে হবে ‘পাঁচটি’ কারণ, খিলাফতে রব্বানী নামক একটি রাজনৈতিক দল যুক্তফ্রন্টের অংশ ছিল এবং এই দল থেকে মনোনীত শাহেদ আলী নির্বাচিত হয়েছিলেন। যা বইয়ে লেখা হয়নি।

একই অধ্যায়ের ১৭৪নং পৃষ্ঠার ৮নং লাইনে ‘নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল’ শিরোনামে পঠিত বিষয়ে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নাম নেই এবং একই পৃষ্ঠার ওপর থেকে ৯নং লাইনে ‘দলীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান’ এর স্থলে হবে ‘আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’। বইয়ের একাদশ অধ্যায়ের ১৮৭নং পৃষ্ঠায় ‘স্বাধীনতা অর্জনে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অবদান : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শিরোনামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। একই পৃষ্ঠায় নিম্ন থেকে ২নং লাইনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি বলা হয়েছে’। অথচ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে’ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়’। উল্লেখ্য, কোনো দেশের রাষ্ট্রপতিকে সরকারের রাষ্ট্রপতি বলা হয় না। একই অধ্যায়ের ১৮৯নং পৃষ্ঠায় নিম্ন থেকে ৭নং লাইনে ‘এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা হিসেবে বলা হয়েছে’। অথচ তিনি ছিলেন তৎকালীন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। যা বইয়ে বলা হয়নি।

‘শিরোনাম : বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত’ পৃষ্ঠা নং-১৯৩ : ‘চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি’ লেখা আছে। শুদ্ধ রূপ : ‘চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে, ও মা আমার প্রাণে বাজার বাঁশি সোনার বাংলা…’। পাঠ্যবইয়ে ‘ও মা’ শব্দটি লেখা নেই। একই অধ্যায়ের ১৯৫নং পৃষ্ঠায় উপর থেকে ২নং লাইনে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ ‘কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরে’ লেখা হয়েছে। অথচ মেহেরপুর বর্তমানে একটি পৃথক জেলা। যা পাঠ্যবইয়ে ভুল। একই বইয়ের চতুদর্শ অধ্যায়ের ২০৩নং পৃষ্ঠার নিম্ন থেকে ১৫নং লাইনে ‘গণতন্ত্র’ উপশিরোনামে লেখা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্র হবে একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র।’ প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে লেখা আছে ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র’ এবং সংবিধানে দেয়া তথ্যের সঙ্গে পাঠ্যবইয়ের তথ্য মিলছে না। একই অধ্যায়ের ২০৭নং পৃষ্ঠায় সর্বশেষ লাইনে লেখা আছে ‘যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি’। কিন্তু এটি হবে ‘যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনি’। একই পৃষ্ঠায় নিম্ন থেকে ৩নং লাইনে লেখা আছে প্রধান চিারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকে ‘প্রধান করে’ অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। কিন্তু এর স্থলে ‘অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি’ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়’ লিখতে হবে।

নবম ও দশম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের ২-৯নং পৃষ্ঠার বিভিন্ন জায়গায় ‘শেখ মুজিব’ লেখা হয়েছে। এখানে তার নামের আগে বঙ্গবন্ধু লেখা নেই। লেখা নেই তার পুরো নামও। অথচ বর্তমানে সব ক্ষেত্রে তার নামের পূর্বে ‘বঙ্গবন্ধু’ লিখতে হয়। ১১নং পৃষ্ঠায় ‘১৯৭০ সালের নির্বাচন ও পরবর্তী ঘটনা’ উপ-শিরোনামের নিম্ন থেকে ৪নং লাইনে জাতীয় পরিষদে ‘একক’ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লেখা হয়েছে। অথচ লিখতে হবে ‘নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা’। ১৪নং পৃষ্ঠার উপর থেকে ৩নং লাইনে জাতীয় পরিষদে ‘একক’ সংখ্যাগরিষ্ঠতার স্থলে ‘নিরঙ্কুশ’ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লিখতে হবে। ২২নং পৃষ্ঠায় উপর থেকে ৭নং লাইনে ‘মুজিব নগর সরকারের রাষ্ট্রপতি’ লেখা হয়েছে। এর জায়গায় ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি’ লিখতে হবে। ২৯নং পৃষ্ঠায় নিম্ন থেকে ১৬নং লাইনে ‘প্রেসিডেন্ট ভবন’ লেখা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট ভবন নেই। আছে ‘বঙ্গভবন’। ৮৮নং পৃষ্ঠায় নিম্ন থেকে ৩নং লাইনে লেখা আছে ‘সার্বভৌমের আদর্শই হলো আইন’। এটি ভুল। শুদ্ধ হবে ‘সার্বভৌমের আদেশই হলো আইন’।

১০১নং পৃষ্ঠায় নিম্ন থেকে ৭-৮নং লাইনে লেখা আছে ‘রাষ্ট্রপতি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন’। কিন্তু সংবিধানে বলা আছে অন্য কথা। সংবিধানের ৫৬ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘যে সংসদ সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হইবেন, রাষ্ট্রপতি তাহাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করিবেন’। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে নয়। ১০২নং পৃষ্ঠায় রাষ্ট্রপতির জরুরি ক্ষমতা উপশিরোনামে ‘রাষ্ট্রপতি যদি বুঝতে পারেন যে’। এর স্থলে ‘রাষ্ট্রপতির নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে’। ১১৩নং পৃষ্ঠায় নিম্ন থেকে ১৬-১৭নং লাইনে লেখা আছে ‘কমিশনার’। কিন্তু এটি ভুল। এর স্থলে হবে ‘কাউন্সিলর’। একইসঙ্গে লেখা আছে ‘চেয়ারম্যান’। এর স্থলে হবে ‘মেয়র’। ১১৪নং পৃষ্ঠায় নি¤œ থেকে ১৩নং লাইনে বাংলাদেশের সিটি করপোরেশনে ‘ডেপুটি মেয়র’ আছেন বলে লেখা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের কোনো সিটি করপোরেশনে ‘ডেপুটি মেয়র’ নামে কোনো পদ নেই।

নবম-দশম শ্রেণির পৌরনীতি ও নাগরিকতা বইয়ের ৭নং পৃষ্ঠায় উপর থেকে ২নং লাইনে ‘রাষ্ট্রের ক্ষেত্রফল’ লেখা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যা ‘রাষ্ট্রের আয়তন’ মর্মে উল্লেখ করতে হবে। ২৩নং পৃষ্ঠায় আইনের প্রকারভেদ শিরোনামে যা বর্ণনা করা হয়েছে, আইনের বিভিন্ন শাখার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। ৫৭নং পৃষ্ঠায় বাংলাদেশ সরকার ব্যবস্থা : শিরোনামের অধ্যায়ে লেখা হয়েছে, সরকারের তিনটি বিভাগ রয়েছে, শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ। অথচ সংবিধানে চতুর্থভাগে বলা হয়েছে- ‘নির্বাহী বিভাগ’। কিন্তু তা না লিখে পাঠ্যপুস্তকে লেখা হয়েছে ‘শাসন বিভাগকে নির্বাহী বিভাগও বলা হয়ে থাকে’। প্রকৃত পক্ষে লেখা আবশ্যক ছিল ‘নির্বাহী বিভাগকেও শাসন বিভাগ’ বলা হয়ে থাকে। ৫৭নং পৃষ্ঠার উপর থেকে ৩নং লাইনে লেখা আছে ‘কোনো ব্যক্তি পর পর দুই মেয়াদ অর্থাৎ এক টানা ১০ বছরের বেশি রাষ্ট্রপতি পদে থাকতে পারেন না’।

প্রকৃত পক্ষে বাংলাদেশ সংবিধানের ৫০(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘একাদিক্রমে হোক বা না হোক দুই মেয়াদের অধিক রাষ্ট্রপতির পদে কোনো ব্যক্তি অধিষ্ঠিত থাকিবেন না।’ একই বইয়ের ১১৯নং পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু ও মওলানা ভাসানীর প্রভাতফেরি ছবির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ‘১৯৫৪ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি’। অথচ এই তথ্য বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। কারণ বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে একই ছবির ক্যাপশনে লেখা আছে ‘২১ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩’। ৫১নং পৃষ্ঠায় নিম্ম থেকে ১০নং লাইনে সংবিধান ১৬ বার সংশোধন করা হয়েছে বলে লেখা হয়েছে। অথচ এ পর্যন্ত ১৭ বার সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। ৫৭ নং পৃষ্ঠায় নিম্ম থেকে ১৪নং লাইনে লেখা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান।’

কিন্তু সংবিধানের ৬১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগের সর্বাধিনায়কতা রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত হইবে’ মর্মে উল্লেখ করতে হবে। ৫৮নং পৃষ্ঠায় নিম্ম থেকে ৬নং লাইনে ‘কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি নিজের বিচার-বিবেচনা অনুযায়ী জাতীয় সংসদের যে কোনো সদস্যকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবেন’ বলে লেখা আছে। কিন্তু সংবিধানের এইরূপ কোনো বিধানই নেই। একই পৃষ্ঠার নিচ থেকে ৪নং লাইনে ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যকাল ৫ (পাঁচ) বছর’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ সংবিধানের কোথাও আলাদাভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যের মেয়াদের উল্লেখ করা হয়নি। ৬০নং পৃষ্ঠায় নিচ থেকে ১০নং লাইনে ‘মন্ত্রিসভার সদস্যরা একক ও যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থেকে দায়িত্ব পালন করেন’ বলে লেখা হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে সংবিধানের ৫৫(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকিবেন’। এক্ষেত্রে পাঠ্যবইয়ে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে। ৭৫নং পৃষ্ঠায় উপর থেকে ১০নং লাইনে ‘১০ বার সংসদ নির্বাচন হয়েছে’ বলে লেখা হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে ‘১১’ বার সংসদ নির্বাচন হয়েছে। ৮৬ নং পৃষ্ঠায় উপর থেকে ১০নং লাইনে লেখা আছে ‘মহিলা কাউন্সিলররা নির্বাচিত হন কাউন্সিলরদের ভোটে’। কিন্তু ‘মহিলা কাউন্সিলররা জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন’- এই তথ্যটি চেপে যাওয়া হয়েছে।

নবম-দশম শ্রেণির বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি বইয়ের ১৩০নং পৃষ্ঠায় জাতীয় পতাকার অংশে এর রং সম্পর্কে লেখা হয়েছে ‘উদীয়মান সূর্যের মতো লাল বৃত্ত’। অথচ সংবিধানের ৪(২) নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে ‘প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকা হইতেছে সবুজ ক্ষেত্রের ওপর স্থাপিত রক্ত বর্ণের একটি ভরাট বৃত্ত’। অর্থাৎ জাতীয় পতাকা সম্পর্কেও এখানে ভুল তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। একই বইয়ে জাতীয় সংগীত সম্পর্কে লেখা আছে ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত এক বা একাধিক দেশপ্রেম মূলক গানকে জাতীয় সংগীত হিসেবে বিবেচনা করা হয়’। কিন্তু বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পৃথিবীর কোনো দেশেই একাধিক জাতীয় সংগীত রয়েছে, এমন তথ্য বিভ্রান্তিমূলক। একই বইয়ের ১৯৬নং পৃষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উপশিরোনামে লেখা আছে ‘সোনার বাংলা গঠনের চেতনাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’। অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে- ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম-নিরপেক্ষতা’। যা সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি {৮(১)} হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু পাঠ্যবইয়ে তা অনুপস্থিত। একই বইয়ে ‘জগদীশ চন্দ্র বসু ১৮৫৮ সালের ৩০ শে নভেম্বর ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন’ মর্মে লেখা হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে তার জন্মস্থান মুন্সীগঞ্জ জেলায়।

অষ্টম শ্রেণির বাংলা বই আনন্দপাঠে সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা ‘কাবুলের শেষ প্রহরে’ গল্পে ৬৭নং পৃষ্ঠায় শব্দার্থ ও টীকায় ‘তাসখন্দকে’ রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্য লেখা হয়েছে। কিন্তু এটি ভুল। প্রকৃতপক্ষে ‘তাসখন্দ’ বর্তমান উজবেকিস্তানের রাজধানী। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের ১৩নং পৃষ্ঠায় উপর থেকে ২নং লাইনে ‘মাইল’-এর স্থলে ‘কিলোমিটার’ হবে। ১৪নং পৃষ্ঠায় উপর থেকে ১নং লাইনে জুলফিকার আলী ভুট্টোর কোনো পরিচয় না দিয়েই আকস্মিকভাবে ‘অন্যদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টো’ লেখা হয়েছে। ৩০নং পৃষ্ঠায় উপর থেকে ১৬ ও ১৭ নং লাইনে ১৯৭১ এর ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেবকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে হত্যা করা হয়।

৭৫নং পৃষ্ঠায় উপর থেকে ৮নং লাইনে জাতি ও জাতীয়তা : ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বাদে জাতি হিসেবে বাংলাদেশের জনগণ ‘বাঙালি’ নামে পরিচিত হবে এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের পরিচয় হবে ‘বাংলাদেশি’। কিন্তু সংবিধানের ৬(২)নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকরা বাংলাদেশি বলিয়া পরিচিত হইবেন’। এখানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য আলাদাভাবে কিছু বলা হয়নি। অর্থাৎ জাতি হিসেবে সবাই বাঙালি। একই পৃষ্ঠায় দফা ১৩. নির্বাচন অনুষ্ঠান উপশিরোনামে ‘কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে বা অবলুপ্ত হলে সংবিধান অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে’ বলে লেখা আছে। অথচ সংবিধানের ১২৩(৩)(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী- ‘মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে এবং ১২৩(৩)(খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী-মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে’।

সপ্তম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ের ১০নং পৃষ্ঠার উপর থেকে ৫ ও ৬ নং লাইনে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচন ছিল শুধু পূর্ব পাকিস্তানের। অথচ এটিও ভুল তথ্য। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের সব প্রদেশে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হয়েছিল। ৫৬-৫৭নং পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা। এখানে মনিপুরি ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর বর্ণনায় বাংলাদেশের কোন অঞ্চলে তাদের বাস, তার কোনো উল্লেখ নেই। একই শ্রেণির গণিত বইয়ের ‘ফ্রন্ট ইনার’ এ লেখা আছে, ‘বঙ্গবন্ধু করাচি কারাগার থেকে মুক্ত হন’। এই তথ্যটি সঠিক নয়। প্রকৃত তথ্য, তিনি রাওয়ালপিন্ডির মিনাওয়ালি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন।

ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি শীর্ষক অধ্যায়ের ৩নং পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ‘এ সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মতো এক সাহসী, ত্যাগী ও দূরদর্শী নেতার ‘আবির্ভাব’ হয়। অথচ প্রকৃত সত্য এই, বঙ্গবন্ধু হঠাৎ কোনো ‘আবির্ভূত’ নেতা নন। তিনি তিলে তিলে বাঙালি জাতির নেতা হয়ে উঠেছেন। তিনি পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পূর্ব থেকেই বাঙালি জাতির নেতা হয়ে উঠেছেন। এখানে ভুল ইতিহাস শেখানো হচ্ছে। একইশ্রেণির বাংলা বই চারু পাঠে সততার পুরস্কার গল্পে পৃষ্ঠা নং-৪-এ বহু নির্বাচনি প্রশ্নের ১নং-এ প্রশ্ন করা হয়েছে ‘ফেরেশতা কোন ইহুদিদের কাছে এসেছিলেন?’ অথচ পুরো গল্পের কোনো স্থানে তিন ব্যক্তির কোনো ধর্ম-পরিচয় বলা হয়নি। ১৯নং পৃষ্ঠায় পাঠ পরিচিতিতে মিসরের বর্ণনায় মিসরকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ হিসেবে বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মিসরের ভৌগোলিক অবস্থান ‘উত্তর আফ্রিকায়’। ২৬নং পৃষ্ঠায় গারো পাহাড় রংপুরে রয়েছে বলে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে রংপুর অঞ্চলে কোনো পাহাড় নেই। ৫১নং পৃষ্ঠায় লেখক পরিচিতিতে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামানকে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরিটাস অধ্যাপক বলা হয়েছে। তার অধিকতর পরিচয় লেখা নেই। অথচ তিনি শিক্ষকতা জীবনে চট্টগ্রাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন।

Comments are closed.