আড্ডার কাজ শেষ করে বাড়িতে ফিরে আল ফারাবী চিন্তার সাগরে ঝাপ দিল।
আজ ওর মনটা বড় অস্থির। সে ঐ গ্রুপের মধ্যে জানা শোনায় সবচেয়ে দূর্বল।
সে আগে মনে করত তার দ্বারা কিছু হবে না এজন্য কখনও লেখাপড়ায় মনোযোগ দেয়নি।
কিন্তু এই গ্রুপের সাথে মেশার পর তার চিন্তা ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে।
সে একসময় ভাবত যে, আল্লাহ তাকে ব্রেন কম দিয়ে সৃষ্টি করেছে তাই তার এই অবস্থা! সুতরাং তার হাজার লেখাপড়া করলেও কোন লাভ হবে না।
পরীক্ষার আগে বাবা মা জোর করে মুরগীর ডিম খাওয়াতো তাই সে পরীক্ষায় ডিমের মতো গোল্লা পায়।
ভয়ে বাবা মাকে বলতেও পারে না যে, মা, পরীক্ষার সময় ডিম খেলে পরীক্ষার খাতায় ছেলে মেয়েরা গোল্লা পায়। এতদিনের কু-ধারণা বদলেছে এদের সাথে মিশেই।
কয়েকদিন আগে কুরআন শরীফের কয়েকটি আয়াত তাকে বদলে দেয়।
আর সূত্র পায় এই গ্রুপ থেকেই। তার মধ্যে যে দুটি আয়াত খুব ভাল লেগেছে সে আয়াত দুটি সে মনে মনে আওড়ালো কয়েকবার।
যার সহজ সরল বাংলা অনুবাদ করলে হয়- আপনার যে কল্যাণ হয়, তা হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে আর আপনার যে অকল্যাণ হয়, সেটা হয় আপনার নিজের কারণে।
আরেকটি হলো- আমি কোন জাতীর ভাগ্য পরিবর্তন করি না যতক্ষণ না সে জাতি তার নিজের ভাগ্য উন্নয়নে সচেষ্ট না হয় ।
তাছাড়া ভারতের প্রখ্যাত লেখক শিব খেরার একটি কথা তাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে।
তা হলো- বিজয়ীরা ভিন্ন কোন কাজ করে না। তারা একই কাজ ভীন্ন ভাবে করে।
তার চিন্তার পরিবর্তনের সাথে সাথে সে পড়ালেখায় মনোযোগী হয়েছে এবং সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
তার বাবা মা-ও চায় সে ঐ আড্ডাবাজদের সাথেই মিশুক। আল ফারাবী মেশার পর থেকে প্রচুর পরিশ্রম করা শুরু করেছে।
সে মাগরিবের নামাজ পড়ে বাড়ীর বাগানে গিয়ে একটু চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল।
পাশে আমগাছের ডালে বসা একটা পাখি ডেকে উঠল কোমল সুরে।
সে ভাবতে লাগল মানুষ কত সুন্দর করে কথা বলে অথচ পাখি, গরু-ছাগল, মুরগির ভাষা কেমন যেন আমরা বুঝতে পারি না।
পশু পাখির ভাষা যদি বুঝা যেত তাহলে কতই না ভাল হতো!
চিন্তা করছিল সে- একেক এলাকার মানুষ একেকভাবে কথা বলে কিন্তু পশু পাখির ভাষার কোন পরিবর্তন নেই কেন? মুরগীর বাচ্চা আর মুরগীর ভাষার মধ্যে কেন পার্থক্য নেই।
গরুর সেই হাম্বা ডাক জম্মের পর থেকেই শুনছে অথচ আজও একই রকম।
তার বাড়ীর গরু যেভাবে হাম্বা বলে ডাকে, সে রাজশাহী বেড়াতে গিয়ে দেখেছে সেখানকার গরুও হাম্বা ডাকে।
অথচ সেখানকার মানুষের মুখের ভাষা এখানকার মানুষের মুখের ভাষার মতো নয়। অবশ্য সে জানে এটাকে উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা বলে।
তার পাশের পাবনা জেলার, চাটমোহর থানার মধ্যে সাইকোলা গ্রামের মানুষ আবার ‘ক্যাবা কইরা কথা কয়’!
অনেকক্ষণ ভাবল সে । ভাবার পরে নিজে নিজেই হাসল। বাচ্চা মানুষের মতো তার চিন্তা হচ্ছে কেন?
এই গ্রুপে আসার পর থেকেই তার কি যে হয়েছে সব কেমন যেন অচেনা অচেনা লাগে!
প্রথম একদিনের একটা কর্মশালায় অংশ নেয়ার পর সে বাড়ীতে এসে মনে হলো চিনতেই পারছে না তার পড়ার টেবিল।
বইগুলো অগোছালো। মাথা আঁচড়ানোর চিরুনিতে চুল লেগে আছে। কালো হয়ে গেছে চিরুনি।
কলমের হেড সে কামড়িয়ে কামড়িয়ে নষ্ট করেছে। খাতার পাতা যখন মনে হয়েছে যেখান সেখান থেকে ছিড়েছে। টেবিলের সামনের জানালায় মাকড়শার ঝুল পড়ে গেছে।
কি আশ্চর্য এতদিন তার এসব চোখে পড়েনি কেন? কি নোংরা সে ! নিজেকেই নিজে বলল।
আর ভাবল না সে। পড়ার টেবিলে বসল। রাহীর করা প্রশ্নের উত্তর সে সবচেয়ে সুন্দর করে দিতে চায়।
অক্ষর জ্ঞানহীন মানুষে কিভাবে ভাষা চিনে? সে চিন্তা করেছে ভাষা কাকে বলে সে এটাও বলে দিতে চায় সবার আগে। এজন্য সে দু-তিনটা বইও যোগাড় করে এনেছে।
পড়া শুরু করল সে- পৃথিবীতে প্রায় মতান্তরে ৫/৬/৭ হাজারের মতো ভাষা আছে।
তম্মোধ্য প্রচলিত আছে আড়াই হাজারের মতো আবার অনেকে বলেন সাড়ে তিন হাজারের মতো।
ভাষা-ভাষী জনসংখ্যার দিক থেকে আমাদের বাংলা ভাষা হলো পৃথিবীর চতুর্থতম বৃহৎ মাতৃভাষা।
বাংলা ভাষায় কথা বলেন প্রায় ২৪ কোটি লোক। ভাষা ধারণাটি কোন সুনির্দিষ্ট, যৌক্তিক ও অবিতর্কিত সংজ্ঞা দেয়া কঠিন।
কেননা যে কোন কিছুর সংজ্ঞা ভাষার মাধ্যমেই দিতে হয়।
ভাষার একটি কার্যনির্বাহী সংজ্ঞা হিসাবে বলা যায় যে, ভাষা মানুষের মস্তিষ্কজাত একটি মানসিক ক্ষমতা যা বাক-সংকেতে রুপায়িত (ধ্বনিভিত্তিক বা লৈখিক রুপে) হয়ে একই সমাজের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে সহায়ত করে।
সুতরাং ভাষা হলো মানুষে মানুষে যোগাযোগের প্রধানতম বাহন।
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। মায়ের কাছ থেকে শেখা ভাষাকে মাতৃভাষা বলে।
যার মা বেঁচে নেই অর্থাৎ হয়তো জম্ম দেবার পরই মমতাময়ী মা মারা গেছে অথবা জম্মের পর আর মায়ের কাছে কিছু শেখার ভাগ্য হয়নি, মায়ের মুখের মিষ্টি কথাও হয়তো শুনা হয়নি তাদের মাতৃভাষা হবে সে প্রথম যার কাছে লালিত পালিত হয়েছে।
অর্থাৎ জম্মের পর থেকে যাদের সেবা যত্নে শিশুটি বড় হয় তাদের শেখানো ভাষাটিই হলো মাতৃভাষা।
যাদের মা ইংরেজি ভাষা শেখান তাদের মাতৃভাষা ইংলিশ আবার যাদের মা আরবি ভাষা শেখান তাদের মাতৃভাষা আরবি বা এরাবিক।
ভাষাকে ইংরেজিতে বলে Language অথচ মাতৃভাষাকে Mother’s Language না বলে বলা হয় Mother Tongue (মাদার টাং) ।
আশ্চর্য্য বিষয়তো! তবে অনেক বইতে Mother’s Language ও বলা হয়েছে। ভাবছিল আল ফারাবী।
ভাষার সংজ্ঞা ওকে মুখস্ত করতেই হবে। তাই কয়েক লাইন বাদ দিয়ে আবার পড়া শুরু করল।
ভাষা সম্পর্কে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, “মনুষ্য জাতি যে ধ্বনীসব দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করে তার নাম ভাষা”।
ড. সুনীত কুমার চট্রোপাধ্যায় বলেন, “মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য বাগযন্ত্রের সাহায্যে ধ্বনির দ্বারা কোন বিশেষ জনসমাজে ব্যবহৃত স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত তথ্য বাক্যে প্রযুক্ত শব্দসমষ্টিকে ভাষা বলে”।
ড. সুকুমার সেন বলেন, “মানুষের কন্ঠোদ্গীর্ণ অর্থবহ ধ্বনিসমষ্টিই ভাষা”।
ভেন্ডার জেনডিন (James W. Vander Zanden) এর ভাষায় “ভাষা হচ্ছে সামাজিকভাবে কাঠামোবদ্ধ একটি পদ্ধতি, যেখানে নির্দিষ্ট এবং স্বেচ্ছামূলক অর্থসহ শব্দের ধরণ, কথা এবং বাক্য থাকে”।
সমাজবিজ্ঞানী আর.টি.স্ক্যাফার (R.T. Schaefer) তার Sociology গ্রন্থে বলেন “ ভাষা হচ্ছে সংস্কৃতির উপাদানের প্রতীক ও শব্দার্থের একটি বিমূর্ত ব্যবস্থা।”
বিশিষ্ট সংজ্ঞাবিদ Dr. Restart K- এর মতে “ভাষা হচ্ছে মনোভাব প্রকাশের জন্য মানুষের ফুসফুসতাড়িত বায়ু গলনালী, মুখবিহবর, কন্ঠ, জিহবা, তালু, দন্ত, ওষ্ঠ, নাসিকা প্রভৃতি বাগযন্ত্রের মাধ্যমে বেরিয়ে আসার সময় যে আওয়াজ বা ধ্বনির সৃষ্টি হয় তার নাম ভাষা”।
এত সংজ্ঞা সে মনে রাখবে? তারই যে অবস্থা ছোটরা এগুলো মুখস্ত রাখে কীভাবে ! তাও সে সব ধরণের চেষ্টাকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে।
আর পড়া এগিয়ে নিতে পারল না। ভাষার কথা আসলেই শুধু মানুষের কথা আসছে কেন?
তাহলে অন্য পশু-পাখি? ওদের কি ভাষা নেই?
কিভাবে সম্ভব! একটা মুরগী তার বাচ্চাকে একটা শব্দ করে সাবধান করে আবার কাছে ডাকে, তাদের চাহিদা জানায়। তাহলে ভাষার কথা উঠলেই শুধু মানুষের কথা আসছে কেন?
মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠল। সে আর পড়ায় মনোযোগ বসাতে পারল না। উঠে গেল পড়ার টেবিল থেকে।
Comments are closed.