কোভিড ভ্যাকসিন: করোনার টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে যেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হচ্ছে
বাংলাদেশে টিকার মজুদ ফুরিয়ে আসায় এবং এখন পর্যন্ত নতুন টিকার চালান এসে না পৌঁছনয় প্রথম ডোজ পাওয়া অনেক মানুষই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন দ্বিতীয় ডোজ যথাসময়ে পাবেন কি না, কিংবা আদৌ পাবেন কি না।
শনিবার ঢাকার শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, অনেকের দ্বিতীয় ডোজের নির্ধারিত তারিখ থাকার পরেও তারা টিকা নেয়ার এসএমএস পাননি। ফলে তারা টিকা নিতে পারেননি।
বনশ্রী থেকে আসা আলী হোসেন বলছেন, “আমার কাগজে টিকার তারিখ দেখা আছে ৮ই মে। কিন্তু আজ এখানে আসার পরে বলছে, এসএমএস না এলে টিকা দেয়া হবে না”।
উত্তরা থেকে এসেছেন সাবিনা ইয়াসমিন। তার টিকার তারিখ ৭ই মে হলেও এখনো তিনি এসএমএস পাননি। টিকার কাগজ নিয়ে এসেও তিনিও টিকা নিতে পারেননি।
এমন মানুষের সংখ্যা ১৩ লাখের বেশি হয়ে বসতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৫৮ লাখ ১৯ হাজার ৮৫৪ জন, আর দ্বিতীয় ডোজ টিকা পেয়েছেন ৩৩ লাখ ১৩ হাজার ৮২৪ জন। প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত টিকা দেয়া হয়েছে ৯১ লাখ ৩৩ হাজার ২৭৮ ডোজ।
ভারত থেকে কেনা এবং উপহার হিসাবে পাওয়া মিলিয়ে দেশে টিকা রয়েছে এক কোটি ২ লাখ ডোজ। অর্থাৎ সরকারের হাতে এখন রয়েছে মাত্র ১১ লাখ ডোজের মতো টিকা রয়েছে।
প্রথম ডোজের টিকা নিয়েছেন, কিন্তু শুক্রবার পর্যন্ত দ্বিতীয় ডোজের টিকা পাননি এরকম মানুষ রয়েছেন ২৫ লাখ ৬ হাজার ৩০ জন। অর্থাৎ ১৩ লাখের বেশি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় দ্বিতীয় ডোজের টিকাই এই মুহূর্তে সরকারের হাতে নেই।
কতদিনের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ নেয়া যাবে?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সৌমিয়া সোয়ামিনাথান বলছেন, ”বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ হচ্ছে, অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের ১২ সপ্তাহ (তিনমাস) পর্যন্ত সময়সীমা বৃদ্ধির উদাহরণ রয়েছে। এর ফলে আরও বেশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় বলে বলা হচ্ছে।”
তিনি বলছেন, ”এ ধরনের টিকার ক্ষেত্রে দুইটি ডোজ নেয়া গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে যদি কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ দেরিও হয়, তারপরেও দ্বিতীয় ডোজ নেয়া দরকার। কারণ প্রথম ডোজে আসলে নতুন অ্যান্টিজেন শরীরের ভেতর প্রবেশ করে, দ্বিতীয় ডোজের মাধ্যমে সেটার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়া হয়।”
বিশ্বের অনেক দেশেই প্রথম টিকা নেয়ার পরবর্তী ১২ সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার কথা বলা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে অন্যতম মুখপাত্র অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেছেন, ”অক্সফোর্ড- অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রথম ডোজের পর ১২ সপ্তাহ, এমনকি তার পরেও দ্বিতীয় ডোজ নেয়া যেতে পারে। ফলে দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে ভয়ের কোন কারণ নেই।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান বিবিসিকে বলেছেন, ”দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার পর যারা বাকি থাকবেন, তাদের কবে টিকা দেয়া যাবে, সেটা নির্ভর করবে টিকা হাতে পাওয়ার ওপরে। আমরা আশা করছি, তাদের টিকার কার্যকারিতা সময়ের মধ্যে টিকা আসবে।”
যারা কোভিশিল্ড নিয়েছেন, তারা কি অন্য টিকা নিতে পারবেন?
ড. সৌমিয়া সোয়ামিনাথান বলছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানও পরিবর্তিত হচ্ছে। এখন বিশ্বে যেসব ট্রায়াল চলছে, সেখানে দুই ধরনের দুইটি টিকা নেয়ার পরীক্ষাও করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত দুই কোম্পানির দুই ডোজ টিকা নেয়ার ব্যাপারে সুপারিশ করার মতো পর্যাপ্ত তথ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হাতে নেই। তবে এখন পর্যন্ত এটাই সুপারিশ করা হচ্ছে যে, যারা প্রথম ডোজ যে টিকা নিয়েছেন, দ্বিতীয় ডোজও সেটা নেবেন।
দুই কোম্পানির দুইটি আলাদা ডোজ নেয়ার বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশের করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গঠিত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক কমিটি।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান বলছেন, ”বিশেষজ্ঞ কমিটি এক টিকার সঙ্গে অন্য টিকা নেয়ার বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন। ফলে যারা কোভিশিল্ড পেয়েছেন, তারা সেটাই পাবেন।”
বাংলাদেশে কেন টিকার এই সংকট?
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কোভিশিল্ড বাংলাদেশে দেয়ার জন্য ভারতের সিরাম ইন্সটিটিউটের সঙ্গে বেক্সিমকোর মাধ্যমে চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ সরকার। ছয়মাসের মধ্যে তিন কোটি টিকা আনার চুক্তি হয়েছিল।
গত জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত থেকে দুই চালানে ৭০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশ পেয়েছে।
এছাড়া ভারত সরকারের উপহার হিসাবে দিয়েছে ৩২ লাখ ডোজ।
সবমিলিয়ে বাংলাদেশ হাতে পেয়েছে মোট এক কোটি দুই লাখ ডোজ টিকা।
সিরাম ইন্সটিটিউটের সাথে চুক্তি অনুযায়ী প্রতিমাসে ৫০ লাখ ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা বাংলাদেশে আসার কথা, কিন্তু গত দুই মাসে কোন চালান আসেনি।
মূলত সিরাম ইন্সটিটিউটে তৈরি অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কোভিশিল্ডের ওপর নির্ভর করেই বাংলাদেশ টিকা দেয়ার কার্যক্রম শুরু করেছিল।
কিন্তু সম্প্রতি ভারতে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় অদূর ভবিষ্যতে দেশটি থেকে টিকা আসার সম্ভাবনাও নাকচ করে দেয়া হয়েছে।
যে কারণে বাংলাদেশে দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে প্রায় ১৩ লাখ ডোজ টিকার ঘাটতি রয়েছে বলে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোঃ খুরশিদ আলম।
কীভাবে সামলানোর পরিকল্পনা করছে সরকার
ইতোমধ্যেই সরকার প্রথম ডোজের টিকা দেয়া এবং নিবন্ধন কার্যক্রমও স্থগিত করে দিয়েছে।
এখন শুধুমাত্র দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বিবিসিকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেছেন, “আপাতত টিকার নিবন্ধন আমরা স্থগিত করেছি। আপনারা জানেন, টিকার চালান চুক্তিমত আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়নি। যে কারণে আপাতত যাদের নিবন্ধন করা আছে তাদেরই টিকা দেয়া শেষ করতে চাই আমরা।”
কর্মকর্তারা বলছেন, টিকা আনার ব্যাপারে কূটনৈতিক পর্যায়েও ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
এছাড়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এক থেকে দুই কোটি ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দেশের চলমান টিকা কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার জন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে অন্তত ৪০ লাখ ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা চাওয়া হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন সংগ্রহের জন্য সরকার সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ আশা করছে, মে মাসের মধ্যেই রাশিয়া এবং চীন থেকে টিকা আনা সম্ভব হবে।
রাশিয়া, চীন থেকে টিকা আনার ব্যাপারে সরকার যোগাযোগ শুরু করেছে বলে তিনি জানান। এছাড়া বাংলাদেশের একটি ফার্মাসিউটিক্যালস মডার্নার ভ্যাকসিন আমদানি করার জন্যও আবেদন করেছে।- বিবিসি
Comments are closed.