সাক্ষরতা, বৈজ্ঞানীক সাক্ষরতা, বৈজ্ঞানীক সাক্ষরসম্পন্ন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য
সাক্ষরতা, বৈজ্ঞানীক সাক্ষরতা, বৈজ্ঞানীক সাক্ষরসম্পন্ন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য [Latest-2020]
এখানে যা যা আছে একনজরে...
বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতা
‘সাক্ষরতা’ শব্দটির সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। একজন ব্যক্তি সাক্ষর – এটি বলতে সাধারণভাবে আমরা বুঝি যে, ব্যক্তিটি কোন একটি লেখা পড়ে বুঝতে পারেন, দৈনন্দিন কাজে লিখতে পারেন, কোনকিছু শুনে বুঝতে পারেন ও প্রয়োজনীয় কথাগুলো বলতে পারেন। এ সাক্ষরতাকে মূলত বলা হয় ভাষাগত সাক্ষরতা।
বর্তমানে ভাষাগত সাক্ষরতা Language/linguistic literacy) ও গাণিতিক সাক্ষরতার (numeracy) সাথে বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতা অর্জনও শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে (OECD, 2006)।
একজন মানুষ বৈজ্ঞানিকভাবে সাক্ষর – এটি বলতে কী বোঝায়?

বৈজ্ঞানিকভাবে সাক্ষর একজন মানুষের বৈশিষ্ট্য
চিত্র ১.১ এর মাধ্যমে বৈজ্ঞানিকভাবে সাক্ষর একজন মানুষের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করা যায়। বৈশিষ্ট্যগুলো বিশ্লেষণ করলে কী দেখতে পাই?
নিচে বৈজ্ঞানিকভাবে সাক্ষর একজন মানুষের বৈশিষ্ট্যসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
(ক) বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতার প্রথম শর্তই হলো একজন মানুষ তার চারপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশকে বুঝতে বা অনুধাবন করতে আগ্রহী হবেন।
অর্থাৎ একজন মানুষ তার আশেপাশে কি ঘটছে, কেন ঘটছে এ সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে আগ্রহী হবেন।
একজন মানুষের আাগ্রহ না থাকলে কোন ভাবেই তাকে কোন বিষয়ে জানানো বা বোঝানো সম্ভব নয়। কারো যদি কোন কিছু সম্পর্কে আগ্রহ বা কৌতুহল থাকে তাহলে সে নিজেই প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন বা যোগাড় করে নিতে পারে।
ধরা যাক কোন একজন ব্যক্তি খেয়াল করলেন, হঠাৎ তার পুকুরের মাছ মরে যেতে শুরু করেছে। বৈজ্ঞানিকভাবে সাক্ষর হলে এই ব্যক্তি মাছ মারা যাওয়ার কারণ জানতে ও বুঝতে আগ্রহী হবেন।
(খ) বৈজ্ঞানিকভাবে সাক্ষর একজন ব্যক্তির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো তিনি একদিকে অন্যের বক্তব্য, মত বা দাবি খোলা মনে শুনবেন অর্থাৎ গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকবেন।
তবে কোন বক্তব্য বা দাবিই বিনা প্রশ্নে বা বিচারে মেনে নেবেন না বা গ্রহণ করবেন না।
অন্যকথায়, নতুন কোন কিছুকে যাচাই বাছাই করেই তবে তা গ্রহণ করবেন। যেমন আমরা অনেক সময়ই শুনে থাকি কোন ধর্মীয় ব্যক্তি বা বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তি (পীর, ফকির, ওঝা, সাধু, সন্ন্যাসী) ঝাঁড়ফুঁক দিয়ে পানি পড়া দিলে রোগ ভালো হয়।
এক্ষেত্রে একজন বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতাসম্পন্ন ব্যক্তি যাচাই না করে চিকিৎসার জন্য ঐ ব্যক্তির কাছে ছুটে যাবেন না।
তিনি বরং যাচাই করে জানার চেষ্টা করে দেখবেন আসলেই এসবে রোগ ভালো হয় কিনা।
খোঁজ নিয়ে হয়তো দেখা যাবে যে, একশ জন রোগীর মধ্যে নিরানব্বই জন রোগীর-ই কোন উপকার হয় না।
এক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিকভাবে সাক্ষর একজন ব্যক্তি পীর-ফকির বা সাধু-সন্ন্যাসীর কাছে না গিয়ে ডাক্তারের কাছেই চিকিৎসার জন্য যাবেন।
(গ) বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতাসম্পন্ন ব্যক্তির তৃতীয় বৈশিষ্ট্য বা সামর্থ্য হলো বিজ্ঞান সম্পর্কিত ইস্যু বা বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিতে সক্ষম হওয়া।
বিজ্ঞান বিষয়ক ইস্যুতে আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য একজন মানুষের বিজ্ঞানী বা বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই।
তবে তাকে অবশ্যই ঐ বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান রাখতে হবে। একইসাথে তাকে বুঝতে হবে বিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে।
যেমন পত্রিকায় খবর বের হলো যে সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে যে, মানুষের বুড়িয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব।
অর্থাৎ ভবিষ্যতে মানুষ হয়তো আর বৃদ্ধ হবে না। বিজ্ঞানীরা ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, ইঁদুরের বুড়িয়ে যাওয়া বিলম্বিত করা গেছে।
যিনি বিজ্ঞান সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন না তিনি হয়তো বিষয়টি একদম উড়িয়ে দেবেন অথবা একেবারেই বিনা প্রশ্নে মেনে নেবেন কিংবা আলোচনা থেকে বিরত থাকবেন।
কিন্তু আমরা জানি যে, মানুষের জীবন ও শরীর সম্পর্কে অনেক আবিষ্কারই প্রথমে ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করে দেখে তারপর মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে।
এটি জানলে একজন ব্যক্তি উপরিউক্ত খবরটি পড়ে এ সম্পর্কে আরো জানতে উৎসাহিত হবেন এবং আলোচনায় অংশ নেবেন।
(ঘ) সমস্যা সনাক্ত করে অনুসন্ধান করে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা ঐ সমাস্যার সমাধান খোঁজা একজন বৈজ্ঞানিকভাবে সাক্ষর মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
আমাদের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরোতে পারে না।
যারা মাধ্যমিক পর্যায়ে ভর্তি হয় তাদের মধ্যেও অনেক শিক্ষার্থীই ধীরে ধীরে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করে।
কেউবা পারিবারিক কৃষিকাজে যুক্ত হয়, কেউবা পারিবারিক ক্ষুদ্র ব্যবসা (যেমন- মুদি দোকানদারি), কেউবা আবার কায়িক শ্রমে আবার কেউবা পোশাক শিল্পে নিয়োজিত হয়ে পড়ে।
আবার যারা টিকে থাকে তাদের খুব কম অংশই নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান শাখায় পড়ে।
শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চ শিক্ষা নেয় বড় জোর ১ থেকে ২ শতাংশ। বাকি ৯৮-৯৯ শতাংশ মানুষের বিজ্ঞান পড়ে না বা তাদের সরাসরি বিজ্ঞান সংশ্লিষ্টতা থাকে না। কিন্তু ১০০ শতাংশ মানুষকেই বিজ্ঞানের ওপর পরোক্ষভাবে নির্ভর করতে হয়।
যে কোন মানুষকে তার দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সমাধান করতে হয়, যেসব সমস্যার মধ্যে বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট সমস্যাও রয়েছে। যেমন, গ্রামের একজন নারী তার বাড়ির সাথে এক খন্ড পতিত জমিতে লাউ চাষ করেছেন।
কিন্তু দু’মাস পার হওয়ার পরেও দেখা গেল গাছগুলো সেভাবে বাড়ছে না। এক্ষেত্রে তিনি কী করতে পারেন? তিনি যদি সমস্যা সনাক্ত করে পদ্ধতিগতভাবে অনুসন্ধান করতে পারেন এবং সমাধান বের করতে পারেন। তবে ঐ নারীকে আমরা বৈজ্ঞানিকভাবে সাক্ষর বলতে পারি।
(ঙ) সবশেষে, একজন বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতাসম্পন্ন মানুষ তার চারপাশের পরিবেশ, নিজের ও পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য ও মঙ্গলের ব্যাপারে বিবেচনাপ্রসূত বা সচেতন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন।
বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তাকে অবশ্যই বিজ্ঞানের জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী হতে হবে।
সেই সাথে তাকে অনুসন্ধানী হতে হবে, তাকে বৈজ্ঞানিক ইস্যুতে আলোচনায় অংশগ্রহণে সক্ষম হতে হবে, এবং অন্যদের দাবিকৃত বক্তব্য প্রশ্ন করে যাচাই বাছাই করতে হবে।
বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতাসম্পন্ন মানুষের সর্বশেষ বৈশিষ্ট্যটি অর্থাৎ বিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ইতোমধ্যে বর্ণিত চারটি বৈশিষ্ট্যই তাকে অর্জন করতে হবে।
একটি উদাহরণ থেকে বিষয়টি ভালোভাবে বোঝা যাবে। আমরা টিভি বিজ্ঞাপনে প্রতিদিনই দেখি যে, অমুক খাবারটি খাওয়ালে শিশুরা লম্বা হয়, বুদ্ধিমান হয়, পড়াশোনায় ভালো হয়, খেলাধুলায় প্রথম হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি।
একজন মা বা বাবা এসব বিজ্ঞাপন দেখেই কি তার সন্তানকে ঐ খাবারটি খাওয়ানো শুরু করবেন? যদি কোন বাবা বা মা তা করেন তবে তাকে আমরা বৈজ্ঞানিকভাবে সাক্ষর বলবো? নিশ্চয়ই না।
একজন বাবা/মা তার সন্তানকে ঐ খাবারটি খাওয়ানো শুরু করার আগে বোঝার চেষ্টা করবেন যে, বিজ্ঞাপনে যে দাবিটি করা হচ্ছে (যেমন, এ খাবার লম্বা করে বা বুদ্ধি বাড়ায়) তার কোনবৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কিনা।
যদিও বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয়েছে যে তারা পরীক্ষা করে দেখেছেন, বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতাসম্পন্ন একজন ব্যক্তি এও জানবেন যে সাধারণত শিশুদের ওপর পরীক্ষা করা বিজ্ঞানীরা গ্রহণ করেন না।
তিনি আরও যেটি করবেন তা হলো এ বিষয়ে আরও জ্ঞানী ব্যক্তিদের (যেমন- ডাক্তার বা পুষ্টিবিদ) পরামর্শ নেবেন।
এভাবে একজন বৈজ্ঞানিকভাবে সাক্ষর বাবা বা মা কোন কিছু কেবল শুনেই গ্রহণ করবেন না। আগে পদ্ধতিগতভাবে যাচাই বাছাই করে তারপরই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
আমরা একজন বৈজ্ঞানিকভাবে সাক্ষর একজন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য জানলাম।
এরকম একজন সাক্ষর মানুষ হতে হলে তার কী শিখতে হবে? তার কি বিজ্ঞানের জ্ঞান অর্থাৎ বিজ্ঞানের তত্ত্ব, সূত্র, তথ্য ইত্যাদি মনে রাখতে পারলেই হবে?
ধরা যাক, একজন মানুষ পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়নে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করলো।
তিনি জানেন যে, কী কারণে জন্ডিস হয় এবং জন্ডিস থেকে কীভাবে সুস্থ হওয়া যায়। অথচ তিনি তার জন্ডিসের চিকিৎসার জন্য কোন একজন পীরের পানি পড়া খেলেন। তিনি কী বৈজ্ঞানিকভাবে সাক্ষর? কেন তিনি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে তার রোগের চিকিৎসার পথ খুঁজলেন না? তিনি তো বিজ্ঞানের অনেক কিছু জানেন! তাহলে সমস্যা কোথায়? আসলে তার সমস্যা মানসিকতায়। তিনি বিজ্ঞানের জ্ঞান জানেন কিন্তু সেই জ্ঞান প্রয়োগের মানসিকতা তার নেই। আমরা যদি বৈজ্ঞানিকভাবে সাক্ষর একজন মানুষের বৈশিষ্ট্য ভালোভাবে বিশ্লেষণ করি তা হলে দেখবো যে,
বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতা অর্জনের জন্য একজন মানুষের যা দরকার
বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতা অর্জনের জন্য একজন মানুষের যা দরকার তা হলো :
(ক) আগ্রহ : বিজ্ঞানের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বা আগ্রহ,
(খ) জ্ঞান : বিজ্ঞানের জ্ঞান তথা বিজ্ঞানের ধারণা, তথ্য, তত্ত্ব, সূত্র ইত্যাদি এবং বিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে জ্ঞান,
(গ) দক্ষতা: সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, প্রক্রিয়াকরণ দক্ষতা, অনুসন্ধান করার দক্ষতা, এবং
(ঘ) বৈজ্ঞানিক মূল্যবোধ: অনুসন্ধিৎসা বা কৌতুহল, খোলামনষ্কতা, যাচাই প্রবণতা, প্রশ্ন করার মানসিকতা, পর্যবেক্ষণলব্ধ উপাত্তের ওপর নির্ভর করার মনোভাব ইত্যাদি।
পরিশেষে বলা যায়, বৈজ্ঞানিকভাবে সাক্ষর হতে হলে একজন মানুষকে বিজ্ঞানের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের সাথে সাথে তার বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে এবং সবশেষে তাকে কিছু বৈজ্ঞানিক মূল্যবোধ অর্জন করতে হবে।
এর আগের পোস্ট: মূল্যবোধ এর (নৈতিক মূল্যবোধ এর) সংকট ও উত্তরণ নৈতিক মূল্যবোধ এর অবক্ষয়/সংকট